রবিবার, ০৫ মে ২০২৪, ১১:০২ পূর্বাহ্ন

বয়স্কদের সেবা ও সম্মানের পুরস্কার

বয়স্কদের সেবা ও সম্মানের পুরস্কার

অনুপম সৃষ্টির অধিকারী মহান আল্লাহ গোটা বিশ্বজগেক আপন কুদরতে সৃষ্টি করেছেন। মানুষ তাঁর শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি। নিতান্ত দুর্বল ও হীন অবস্থা থেকে এই মানুষকে তিনি সৃষ্টি করেছেন অভিনব গড়নে ও সুনিপুণ গঠনে।

ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ তোমাদের দুর্বলরূপে সৃষ্টি করেন, অতঃপর দুর্বলতার পর তিনি শক্তি দান করেন, শক্তির পর আবার দেন দুর্বলতা ও বার্ধক্য। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং তিনিই সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান।’ (সুরা : রুম, আয়াত : ৫৪)

মানুষের জীবন, আয়ু আল্লাহ তাআলার এক বড় নিয়ামত। পৃথিবীতে কেউ স্বল্প আয়ুর অধিকারী হয়, কেউ আবার দীর্ঘ জীবনের স্বাদ ভোগ করে। তবে জীবন যদি ঈমান, ইখলাস ও নববী আদর্শের আলোকে পরিচালিত হয় তখন কল্যাণের ক্ষেত্রে বয়সের স্বল্প-দৈর্ঘ্যের পার্থক্য থাকে না। বরং সত্কর্মের সঙ্গে বয়সের দৈর্ঘ্য ব্যক্তির উভয় জগতের কল্যাণ ও সৌভাগ্যের আলোকবর্তিকা হয়ে ধরা দেয়। এ প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যখন তোমাদের কেউ মারা যায়, তখন তার আমল বন্ধ হয়ে যায়, তবে মুমিনের বয়স বৃদ্ধি তার প্রভূত কল্যাণই বয়ে আনে।’ (মুসলিম, হাদিস : ২৬৮২)

সাহাবি আবু বাকরা (রা.) থেকে বর্ণিত, কোনো এক ব্যক্তি প্রশ্ন করল, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! উত্তম ব্যক্তি কে? তিনি বললেন, ‘যে দীর্ঘ জীবন পেয়েছে এবং তার আমল সুন্দর হয়েছে।’ সে আবার প্রশ্ন করল, মানুষের মধ্যে কে নিকৃষ্ট? তিনি বললেন, ‘যে দীর্ঘ জীবন পেয়েছে এবং তার আমল খারাপ হয়েছে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৩৩০)

এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলার পথে যে লোক তার চুল সাদা করেছে, অর্থাৎ বুড়ো হয়েছে, তার জন্য কেয়ামতের দিন একটি আলোকবর্তিকা থাকবে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১৬৩৫)

সুতরাং উত্তম আমলের সঙ্গে দীর্ঘ বয়স মানবজীবনের একটি উত্কৃষ্ট অধ্যায়। এটা যেমনিভাবে পরকালে ব্যক্তির সম্মান, মর্যাদাকে উঁচু করে, তেমনি দুনিয়ায়ও সবার শ্রদ্ধা ও মর্যাদার আসনে সমাসীন করে।

এ পর্যায়ে বয়োবৃদ্ধ ও প্রৌঢ় ব্যক্তিদের অধিকার বিষয়ে ইসলামের অবস্থান তুলে ধরছি। ইসলাম বেশ কিছু ক্ষেত্রে বড়দের অগ্রাধিকার ও সম্মান দিয়েছে।

 

আগে সালাম দেওয়া : ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে, ছোটরা বড়দের আগে সালাম দেবে। সম্মানার্থে বড়দের আগে সালাম দেওয়ার কথা হাদিস শরিফে এসেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) সালামের আদেশ করে বলেছেন, ছোটরা বড়দের সালাম দেবে। (বুখারি, হাদিস : ৬২৩১)

 

সম্মোধনের ক্ষেত্রে সম্মানসূচক শব্দ প্রয়োগ : ক্ষেত্রবিশেষে এবং প্রয়োজনের সময় ছোটরা যখন বড়দের সম্মোধন করবে তখন  অবশ্যই সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রকাশক শব্দ  ব্যবহার  করবে। যেমন : বাবার বয়সী হলে চাচা, কাকা। ভাইয়ের বয়সী হলে বড় ভাই। দাদার বয়সী হলে দাদা ইত্যাদি শব্দে সম্মোধন করবে।

সাহাবি আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) বলেন, বদর যুদ্ধের দিন আমি সারিতে দাঁড়িয়ে ডানে-বাঁয়ে লক্ষ করে দেখি আমার দুই পাশে দুই আনসার বালক দাঁড়িয়ে আছে। আমি মনে মনে ভাবলাম যে আমি তাদের থেকে বেশি সাহসী হব। কিছুক্ষণ পর তাদের একজন আমাকে বলল—চাচা আপনি কি আবু জাহেলকে চেনেন? উত্তরে আমি বললাম—তাকে আমি চিনি, কিন্তু ভাতিজা তোমরা তাকে চিনে কী করবে? একজন বলল—আমি জেনেছি যে সে রাসুলকে গালি দেয়। আল্লাহর কসম! যদি আমি তাকে দেখি তাহলে হয় আমি না হয় সে, যে কেউ একজন অবশ্যই মরবে। অনুরূপ দ্বিতীয়জনও বলল। কিছুক্ষণ পর আবু জাহেলকে মানুষের মধ্যে ঘুরতে দেখে তাদের বললাম এই তো তোমাদের কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি। তখন তারা দ্রুতগতিতে তার দিকে ছুটে গেল এবং তাকে হত্যা করল। (বুখারি, হাদিস : ৩১৪১)

 

কথা বলার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার : ইসলামের নির্দেশ এবং সৌন্দর্য হচ্ছে—কোনো সভা-সমিতি, অনুষ্ঠান ও মজলিসে বক্তব্য প্রদানের ক্ষেত্রে বড়দের আগে সুযোগ প্রদান করা।

একবার তিন সাহাবি—আব্দুর রহমান বিন সাহাল, মুহাইয়্যাসাহ এবং খুয়াইসা ইবনে মাসুদ নবীজির দরবারে গেলেন। আব্দুর রহমান বিন সাহাল প্রথমে কথা বলতে শুরু করলেন। নবীজি তাঁকে থামিয়ে বললেন—বড়কে আগে কথা বলতে দাও। (কারণ তিনি সবার ছোট ছিলেন) তিনি তখন চুপ হয়ে গেলেন। বাকি দুজন কথা বলা শুরু করলেন। (বুখারি, হাদিস : ৩১৭৩)

 

অসুস্থতার সময় তাদের সেবাযত্ন করা : মানুষ বৃদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার রোগব্যাধিও বাড়তে থাকে। এ সময় প্রত্যেকেই কামনা করে, আমার পাশে কেউ থাকুক। আমার সেবা করুক। তাই ইসলাম বয়স্ক ব্যক্তিদের সেবাযত্নের প্রতি যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে তোমরা তাকে ছাড়া অন্য কারো উপাসনা করবে না এবং মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহার করবে; তাদের একজন অথবা উভয়েই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদের (বিরক্তিসূচক শব্দ) ‘উফ’ বোলো না এবং তাদের ভর্ত্সনা কোরো না; বরং তাদের সঙ্গে বলো সম্মানসূচক নম্র কথা। (সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ২৩)

এই আয়াতে মহান আল্লাহ তাঁর ইবাদতের পর দ্বিতীয় নম্বরে মাতা-পিতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন। এবং তাদের প্রতি আদব ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে কথা বলার নির্দেশ দিয়েছেন। বিশেষ করে বার্ধক্যে তাদের ‘উফ’ শব্দটিও বলতে এবং তাদের ধমক দিতে নিষেধ করেছেন। কেননা, বার্ধক্যে তাঁরা দুর্বল ও অসহায় হয়ে যান। তাই আল্লাহর কাছে সন্তোষভাজন সে-ই হবে, যে তাদের শ্রদ্ধার দাবি পূরণ করবে। প্রাপ্য অধিকার আদায়ের ব্যাপারে যত্নবান হবে।

 

ইমামতির ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য : ইমামতির ক্ষেত্রেও বয়সে বড় ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। এক হাদিসে নবীজি বলেছেন, ‘যদি তারা হিজরতের দিক দিয়ে বরাবর হয় তাহলে যারা বয়সে বড় তারা ইমামতি করবে।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৬৭৩)

 

কিরাত সংক্ষিপ্ত করা : হাদিস এবং ফিকহের কিতাবগুলোতে একটি মাসআলা আছে, যদি নামাজের কাতারে কোনো বয়স্ক-মুরব্বি ব্যক্তি থাকেন তাহলে ইমাম সাহেব কেরাত সংক্ষিপ্ত করবেন। কারণ লম্বা কেরাত পড়লে তিনি কষ্ট পাবেন।

একবার মুআজ (রা.) কেরাত লম্বা করেছিলেন। মুসল্লিরা অভিযোগ করলে নবীজি বললেন, তুমি লম্বা কেরাত পড়ছ অথচ তোমার পেছনে মুরব্বি, বয়স্ক ব্যক্তি এবং দুর্বল শ্রেণির মানুষরাও নামাজ পড়ছে। (বুখারি, হাদিস : ৭০৫)

এই হাদিস দ্বারা স্পষ্ট যে যদি নামাজের কাতারে দুর্বল বয়স্ক ব্যক্তিরা দাঁড়ান, তাদের প্রতি খেয়াল করে ইমাম সাহেব কেরাত সংক্ষিপ্ত করবেন। আল্লাহ তাআলা আমাদের বয়োবৃদ্ধ ও প্রৌঢ় ব্যক্তিদের যথাযথ সম্মান করার তাওফিক দান করুন।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877